ইস্তাম্বুলের তোপকাপিতে নবীজির স্মৃতিচিহ্ন

ডেক্স রিপোর্ট • মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন জাদুঘর হচ্ছে ইস্তাম্বুলের তোপকাপি। যেহেতু এ জাদুঘরেই সংরক্ষিত আছে নবী পাক (সা.)-এর অতি মূল্যবান তবরুকাত। সঙ্গে মুসা (আ.)-এর লাঠিসহ আগের নবী-রাসুলদের ব্যবহৃত নানা মোবারকসামগ্রী এবং নবী পাক (সা.)-এর পরবর্তীকালে আহলে বাইতসহ সাহাবা-তাবেঈন, তাবে-তাবেঈনের ব্যবহৃত নানা দুর্লভ মোবারকসামগ্রী সযত্নে সংরক্ষিত আছে। আরো আছে তুর্কি সুলতানদের আমলের নানা চোখ-ধাঁধানো দুর্লভ ঐতিহাসিক সামগ্রী।

মূলত জাদুঘর বলতে ছোট বা বড় কিংবা বিশালাকৃতির দালানকে বুঝিয়ে থাকে, যেখানে প্রাচীনকালের নানা দুর্লভ সামগ্রী সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু আলোচ্য বিশ্বখ্যাত তোপকাপি জাদুঘর এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। বসফরাস প্রণালির তীরে ইউরোপীয় অংশে প্রায় তিন দিকে প্রণালিবেষ্টিত এটি তুর্কি সুলতানদের বিখ্যাত সুরক্ষিত আলিশান রাজপ্রাসাদ তথা দুর্গ।

সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশে এই রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। মধ্যযুগীয় অপরূপ দৃষ্টিনন্দন নকশাখচিত তুর্কি স্থাপত্য কাঠামোর মধ্যে সবচেয়ে বর্ধিত কলেবরে নির্মিত এ স্থাপত্য, যার আয়তন প্রায় সাত লাখ বর্গমিটার।

তবরুকাতের প্রাসাদে একজন কারি সুললিত কণ্ঠে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতরত থাকেন। তুর্কি সুলতানদের আমল থেকে পবিত্র তবরুকাতগুলোর সম্মানার্থে এখানে শত শত বছর ধরে কোরআন তিলাওয়াত চলছে। এখানে যেন ভিন্ন পরিবেশ; নুরানি ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশ বিরাজ করছে বলে মনে হবে। মনের থেকে দোয়া-দরুদ চলে আসা স্বাভাবিক।

এখানে আয়নাঘেরা বাক্সের ভেতর নবী করিম (সা.)-এর চুল মোবারক/দাড়ি মোবারক, এক-দুই ফুটের ব্যবধানে ওহুদ যুদ্ধে শহীদ হওয়া দান্দান মোবারক। সব কিছু এমনভাবে সংরক্ষিত আছে, যেন দর্শনার্থী অনায়াসে দেখতে পায়।

কাছেই আছে ‘মোহরে নবুয়ত’। তার কাছে নবী করিম (সা.) কর্তৃক বিভিন্ন রাজার দরবারে প্রেরিত নানা গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্রের কপি, যার আকৃতি ১৬দ্ধ১৯ সেমি, প্রায় ১২ লাইন বিশিষ্ট আরবিতে লিপিবদ্ধ চিঠি মোবারক। এ জাদুঘরে নবী করিম (সা.)-এর ৬০টি দাড়ি মোবারক সংরক্ষিত আছে। অন্যপাশে পাথরখণ্ডে নবী করিম (সা.)-এর পা মোবারকের চিহ্ন সংরক্ষিত আছে। আরেক পাশে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা নবী করিম (সা.)-এর বিশেষ মাথার টুপি ও বক্ষবন্ধনী সংরক্ষিত আছে। প্রাসাদের বৃহত্তর পরিসরের অপর পাশে নবী করিম (সা.)-এর ব্যবহার্য দুটি তলোয়ার সাজানো আছে। মহানবী (সা.) সর্বমোট ৯টি তলোয়ার ব্যবহার করেছিলেন বলে জানা যায়।

আরেক ব্লকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সুরক্ষিত আছে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিত্য ব্যবহার্য বস্ত্র, পাগড়ি, লাঠি, পাদুকা ইত্যাদি মহামূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী। সব কিছুতে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে যথা—কোন স্থান থেকে কোন সালে কিভাবে সংগৃহীত। দেয়ালের সঙ্গে উঁচু আয়নার ঘেরা বাক্সে অতি যত্নসহ মুসা (আ.)-এর লাঠি সাজানো আছে। প্রায় চার-পাঁচ ফুট লম্বা আকৃতির আমাদের দেশীয় কাঠের রং প্রায় ২৫ এ.এম গোলাকৃতির উক্ত আশাতে ছয়-সাতটি গিরা (গিঁট) আছে। মুসা (আ.)-এর এই বিখ্যাত লাঠি মোবারকের অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা পবিত্র কোরআন মাজিদের একাধিক স্থানে আছে।

নিকটস্থ আরেক ব্লকে দাউদ (আ.)-এর ব্যবহৃত তলোয়ার ও চিঠি আছে। আরো আছে আবু বকর ছিদ্দিক (রা.) ও ওমর (রা.)-এর ব্যবহৃত তলোয়ার। তার কাছে আছে ওসমান (রা.) এবং আলী (রা.)-এর ব্যবহৃত তলোয়ার, আরেক পাশে আছে খালেদ বিন ওলিদ (রা.), জাফর তৈয়ার (রা.), আমর বিন ইয়াসির (রা.)-এর ব্যবহার্য তলোয়ার।

প্রাসাদের অন্য বিশাল কক্ষজুড়ে আছে হাজরে আসওয়াদের ১৮৬১ সালের কভার, কাবা শরিফের ছাদের পানি পড়ার নালার (মিজারে রহমতের) সাবেক কাঠামো দুটি, একটি ১৬১২ অন্যটি ১৬৪০ সালের। স্বর্ণের পাত দ্বারা আবৃত নালাদ্বয়ের ওজন ১৪ কেজি করে। পবিত্র কাবাঘরের ছাদের পানি এ সোনালি নালা দিয়ে গড়িয়ে হাতিমের অভ্যন্তরে পড়ে থাকে, যার নাম মিজাবে রহমত।

পবিত্র কাবাগৃহের দরজা ১১৬০ সালের। অতঃপর আব্বাসীয় খেলাফত আমলের উক্ত দরজায় ব্যবহৃত কয়েকটি ডোর-লক। কাবা শরিফের পুরাতন দরজায় ব্যবহৃত কাপড়ের কভার ১৮৫২ সালের।

ওসমানি সুলতান কর্তৃক রওজাপাক ও মসজিদ-ই-নববীর নির্মাণকালীন মডেল ১৮৫২ সালের।

তুরস্কের এ তোপকাপি জাদুঘরে অতি যত্নসহকারে সংরক্ষিত তবরুকাত তুর্কি সুলতানরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকায় যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা স্বাভাবিক। ফলে বিশ্বের অন্য স্থানের সংরক্ষিত তবরুকাতের মধ্যে অনেকগুলোর সত্যতা সম্বন্ধে প্রশ্ন থাকলেও তোপকাপির এই জাদুঘরে যথাযোগ্য মর্যাদায় সংরক্ষিত মহামূল্যবান পবিত্র তবরুকাতগুলোর সত্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিশ্বে কোনো ধরনের প্রশ্ন কিংবা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *